হাজার বছর ধরে = লেখক পরিচিতি
মজুপুর থেকে মিরপুর। বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন দুটো এলাকা এক হয়ে গিয়েছে একটি নামের কারণে- জহির রায়হান। বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। ১৯৩৫ সালের ১৯শে আগস্ট ফেনীর মজুপুরে জন্ম নেন জহির রায়হান। যদিও জন্মসূত্রে বেশ বড়-সড় একটি নাম পেয়েছিলেন : আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাক নাম জাফর। ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকায় চলে আসেন জহির রায়হান। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মেডিক্যাল, অর্থনীতিতে ভর্তি পড়েও, শেষ পর্যন্ত বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
স্কুল জীবন থেকেই লিখতে ভালোবাসতেন। তার লেখা গল্প, কবিতা ছাপা হত পত্রিকায়। তার প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রথমে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় জহির রায়হানের জীবনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হাজার বছর ধরে। সাহিত্যিক হিসেবে তার একমাত্র পুরস্কারপ্রাপ্তি-ও এই উপন্যাসের কল্যাণে। বাংলাদেশের আবহমান গ্রামীণ জীবনের নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটিকে ২০০৫ সালে সুচন্দা চলচ্চিত্ররূপ দেন। জহির রায়হানের পরবর্তী উপন্যাস “আরেক ফাল্গুন”। এই উপন্যাসটি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে রচিত। ছোট গল্পকার হিসেবে অসম্ভব শক্তিশালী ছিলেন জহির রায়হান। নিজেই ‘জহির রায়হানের একশ’ গল্প নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন। যদিও, সেটি আর বাস্তবায়িত হয়নি।
কৈশোরকাল থেকেই সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কমরেড মণি সিংহ তার নাম পাল্টে জহির রায়হান রাখেন। ভাষা আন্দোলনের সময় প্রথম যে দশজনকে গ্রেফতার করা হয়, জহির রায়হান ছিলেন তাদের মাঝে অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের ঝড় সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া জহিরকে পাল্টে দেয়। তার পরবর্তী সৃষ্টিতে তাই বারংবার ভাষা আন্দোলন ফিরে এসেছে। ড. হুমায়ুন আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যার উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা আন্দোলন।..। যদি বায়ান্ন’র একুশ না ঘটতো তবে জহির রায়হান হয়তো কথাশিল্পী হতেন না।”
সাংবাদিকতা, বিশেষ করে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হান। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রবাহ নামক এক মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন তিনি। পরবর্তীতে এক্সপ্রেস নামে একটি ইংরেজী পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদকের কাজও করেছেন। ‘চিত্রালী’-তে ‘প্রবেশ নিষেধ’ শিরোনামে কিছুদিন একটি ধারাবাহিক ফিচার লিখেছিলেন।
চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের জন্মও হয় ছাত্রাবস্থাতেই। ১৯৫৬ সালে প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এ জে কারদার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির অবলম্বনে “জাগো হুয়া সাভেরা” নির্মাণের জন্য ঢাকায় আসেন। পরিচয় হয় জহির রায়হানের সাথে। কারদার জহির রায়হানকে তার সহকারী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এর পর তিনি পরিচালক সালাউদ্দিনের “যে নদী মরুপথে” এবং পরিচালক এহতেশামের “এদেশ তোমার আমার” ছবিতে সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এহতেশামের ছবিটির শীর্ষ সঙ্গীতও লিখেন জহির রায়হান। এই ছবিতে কাজ করার সময়ে, ছবির নায়িকা সুমিতা দেবীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৬১ সালে সুমিতা দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান- বিপুল রায়হান ও অনল রায়হান। পরে ১৯৬৮ সালে জহির রায়হান চিত্রনায়িকা সুচন্দাকে বিয়ে করেন। সুচন্দা ও জহির রায়হানের দুই সন্তান- অপু রায়হান এবং তপু রায়হান।
১৯৬১ সালে জহির রায়হান পরিচালক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন “কখনো আসেনি” ছবির মাধ্যমে। একে একে মুক্তি পায় সোনার কাজল (১৯৬২), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সঙ্গম (১৯৬৪), বাহানা (১৯৬৫), বেহুলা (১৯৬৬) ও আনোয়ারা (১৯৬৭)। একুশে ফেব্রুয়ারী নামে একটি ছবি বানাতে চাইলে কর্তৃপক্ষ বাধ সাধে। ফলে একটু ভিন্ন পথ অবলম্বন করেন জহির রায়হান। ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় তার সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া। এই ছবিতে মেটাফরের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সর্বগ্রাসী, স্বৈরাচারী মনোভাবকে তুলে ধরেন। ইঙ্গিত দেন যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এই ছবি মুক্তি দিতে গিয়ে জহির রায়হানকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। ছবিটি নির্মাণ ও মুক্তি দিতে সরকার পক্ষ নানা টাল-বাহানা শুরু করে। তবে জনতার প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায় ছবিটি। পরিচালনার পাশাপাশি জহির রায়হান অনেকগুলো ছবি প্রযোজনা করেন। সেগুলো হল, জুলেখা (১৯৬৭), দুই ভাই (১৯৬৮), সংসার (১৯৬৮), সুয়োরাণী-দুয়োরাণী (১৯৬৮), কুচবরণ কন্যা (১৯৬৮), মনের মত বউ (১৯৬৯), শেষ পর্যন্ত’ (১৯৬৯) এবং প্রতিশোধ (১৯৭২)।
জহির রায়হান সব সময় তার ছবিতে নিত্য-নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন। ১৯৬৪ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সঙ্গম নির্মাণ করেন এবং পরের বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত বাহানা ছিল সিনেমাস্কোপে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র। ১৯৬৫ সালে জহির রায়হান তার উপন্যাস “আর কতদিন” অবলম্বনে “Let Their Be Light” নামে একটি ছবি করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। জহির রায়হানের ইচ্ছে ছিল, ছবিটি নির্মিত হবে ইংরেজি ভাষায় এবং ডাব করা হবে বাংলা, উর্দু, রুশ এবং ফরাসি ভাষায়। উর্দু এবং ইংরেজি সংলাপ লিখেন কবি ফয়েজ আহমেদ, রুশ সংলাপ লিখবেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রুশ ঔপন্যাসিক মিখাইল শলোকভ। জহির রায়হান এই ছবির কাজ শুরু করেন ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে। ছবির মহরত অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ (বর্তমান রূপসী বাংলায়)। শুটিং শুরু হবার অল্প কিছুদিন পরেই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ছবি অসমাপ্ত রেখে তিনি চলে যান ভারতে।
৫২, ৬৯ এর মত এবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন জহির রায়হান। তবে এবার প্রতিবাদ শুরু করেন ক্যামেরার মাধ্যমে। বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেন পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার চিত্র ধারণ করে। নির্মাণ করেন “Stop Genocide”। এই ছবিটির ধারা বর্ণনা করেন আরেক পরিচালক আলমগীর কবির। ১৯৭১ সালে কলকাতায় জীবন থেকে নেয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। নিজে সে সময় চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও, প্রদর্শনী থেকে পাওয়া সমস্ত অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন। তার সহায়তায় নির্মিত হয় আরও দুটো তথ্যচিত্র। Innocent Million (বাবুল চৌধুরী) ও Liberation Fighters (আলমগীর কবীর)। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে এসে সম্পন্ন করেন তার আরেকটি তথ্যচিত্র A State Is Born-এর কাজ।
বিজয়ের প্রাক্কালে তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে তুলে নিয়ে যায় আল-বদর বাহিনী। দেশে ফেরার পর থেকেই ভাইয়ের সন্ধান করতে থাকেন জহির রায়হান। ৩০শে জানুয়ারী এক ফোন পেয়ে মিরপুর ভাইকে খুঁজতে যান জহির রায়হান। তার মরিস মাইনর গাড়িটিকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেলেও জহির রায়হানের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। ১৯৯৯ সালে সেপ্টেম্বর জুলফিকার আলী মানিকের প্রতিবেদন “নিখোঁজ নন, গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন জহির রায়হান” প্রকাশিত হয়। সেবছর সাপ্তাহিক ২০০০-এ পুত্র অনল রায়হান “বাবার অস্থি’র সন্ধানে” নামে একটি প্রতিবেদন লিখেন। সমাধান হয় জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যের। জানা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তির গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের এই প্রবাদ পুরুষ।
No comments