মহাকবি ফেরদৌসী
(এই গাথাটি বিখ্যাত পারসি মহাকাব্য শাহনামার অন্তর্গত। সেদিন কেউ একজন এর কথা মনে করিয়ে দিলেন। প্রথম এই মহাকাব্যের নাম শুনেছি আমার সুতপাদির মুখ থেকে। পারসিক মহাকবি ফিরদৌসির লেখা এই মহাকাব্যের এক অংশ হল রুস্তম আর তাঁর পুত্র সোহরাবের কথা। আগে পড়েছি, আরেকবার একটু ঝালিয়ে নিয়ে নিজের মত করে লিখলাম।)
জাবুলিস্তান নামের দেশের রাজা ছিলেন রুস্তম। ইরানের রাজার এক বিশ্বস্ত সাহায্যকারী। তাঁর নানা বীরত্বকাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিলো দেশ বিদেশে। একদিন রুস্তম শিকার করতে গেছিলেন তাঁর পছন্দের ইরান আর তুরানের সীমানাঅঞ্চলে। সাথে ছিল প্রিয় ঘোড়া রক্ষ। সারাদিন শিকার করে ক্লান্ত রুস্তম ঘুমিয়ে পড়লেন এক গাছের তলায়। রক্ষকে ছেড়ে দিলেন একা একা চরে বেড়ানোর জন্য। কিন্তু সেদিন সমাঙ্গন রাজ্যের কিছু সৈনিকও সেখানে এসেছিল কিছু রাজকীয় কাজে। তারা হঠাৎ দেখে একটি খুবই উচ্চমানের সুলক্ষণযুক্ত ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে একা একা। আট দশজন মিলে তারা ঘোড়াটিকে বন্দী করল, মনে করল, যদি রাজার আস্তাবলে এতো ভালো ঘোড়াটি উপহার দেওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই মোটা বখশিশ মিলবে।
রুস্তম ঘুম থেকে উঠে দেখেন রক্ষ নেই। খানিক দূরে ধস্তাধস্তির দাগ, ঘোড়ার ক্ষুরের চিহ্ন আর মানুষের পদচিহ্ন ধরে ধরে তিনি পৌঁছে গেলেন সমাঙ্গন রাজ্যে। রাজপ্রাসাদে গিয়ে নিজের সমস্যার কথা জানালেন। রাজা তো এই বীরকে দেখে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিনি কথা দিলেন, রক্ষকে খুঁজে বার করা হবেই, আর যতদিন না হয়, ততদিন বীর রুস্তমকে রাজকীয় আতিথ্য গ্রহন করার অনুরোধ করলেন। রুস্তম রাজী হয়ে গেলেন।
রুস্তমের সম্মানে এক বিরাট ভোজন উৎসব রাখা হল। উৎসবের পর ক্লান্ত রুস্তম রাজঅতিথিশালায় ঘুমোতে গেলেন। শেষ রাতে দরজা ফাঁক হওয়ার ক্ষীণ আওয়াজে সদা সতর্ক বীর উঠে পড়লেন। দরজা দিয়ে এক দাসী আর এক সুন্দরী নারী প্রবেশ করলেন। নারী মৃদুস্বরে জানালেন, তিনি সমাঙ্গন রাজ্যের রাজকন্যা, তাঁর নাম তহমিনা। এক নজরে দেখেই তহমিনাকে খুব পছন্দ হয়ে গেলো রুস্তমের।
রুস্তম - “আমি আপনার জন্য কি করতে পারি রাজকন্যা?”
তহমিনা - “ আমি আপনার বীরত্বগাথা বহু শুনেছি, শুনে আপনাকে মন দিয়ে ফেলেছি জাঁহাপনা।”
রুস্তম - ‘আপনার মত এত অপরূপ সুন্দরী নারীকে দেখে আমিও হৃদয় হারিয়েছি রাজকন্যা।’
তহমিনা - “আপনি কি আমাকে বিবাহ করবেন? আমি কথা দিচ্ছি আজীবন আপনার হয়েই থাকব।”
রুস্তম তো হাতে চাঁদ পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন। পরদিন সকালেই তিনি এক জ্ঞানী বৃদ্ধকে রাজার কাছে পাঠালেন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে। রাজাও খুব খুশি হলেন। খুব শীঘ্রই চারহাত এক হয়ে গেলো।
বেশ কিছু সপ্তাহ সমাঙ্গনে খুব আনন্দে কাটালেন রুস্তম। ইতিমধ্যে রক্ষকেও পাওয়া গেছে। কিন্তু তাঁর আসল দেশ হল জাবুলিস্তান, তাই বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে মনে হল তাঁর। তহমিনাকে মনের কথা খুলে বললেন তিনি। তহমিনা জানালো তিনি রুস্তমের সন্তানের মা হতে চলেছেন। কিন্তু রুস্তমকে যেতেই হবে, দেশের কাজ সবার আগে। তাই তিনি এক রত্ন দিলেন তহমিনাকে, বললেন, “যদি মেয়ে হয় তাহলে তার বিনুনিতে পাথরটি বেঁধে দিও, আর যদি ছেলে হয় তাহলে তার হাতে কবচ করে রত্নটি পরিয়ে দিও।” এই বলে ভারী মন নিয়ে আবার রক্ষের পিঠে চেপে বসলেন তিনি, অশ্রুসজল চোখে তহমিনা তাঁকে বিদায় জানালো।
নির্দিষ্ট সময়ের পরে তহমিনার একটি ফুটফুটে ছেলে হল। তহমিনা তার নাম রাখলেন সোহরাব। সে বাবার মত সুপুরুষ আর শক্তিশালী হচ্ছিল। বড় হওয়ার সময় সে তহমিনাকে বার বার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করত, কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তহমিনা বাবার প্রসঙ্গ বারবার এড়িয়ে যেতেন।
সোহরাব যখন কিশোর হল, তখন অনেক পীড়াপীড়ির পর একদিন তহমিনা সবকথা বলতে বাধ্য হলেন। বললেন সোহরাবের বাবা হলেন বিখ্যাত বীর রুস্তম। সে বিখ্যাত বীর জল এর পৌত্র আর স্যামের প্রপৌত্র। এছাড়াও রুস্তমের দেওয়া কিছু রত্ন এবং রুস্তমের ছোরাটি ছেলেকে দেখালেন তিনি। নিজের গৌরবান্বিত বংশের কথা শুনে সোহরাব খুব আনন্দিত হল, সে জানতে চাইলো, এতদিন এই সত্য তহমিনা তাকে জানাননি কেন?
শুনে তহমিনা জানালেন, রুস্তম হয়তো তাঁর ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বলবেন, বা হয়তো সোহরাব নিজেই অস্ত্রবিদ্যা শেখার জন্য রুস্তমের কাছে চলে যেতে চাইবে, তাহলে তহমিনা একেবারে একা হয়ে যাবেন। এমনিতেই তাঁকে তাঁর স্বামীকে ছেড়ে থাকতে হচ্ছে, এরপর ছেলেও দূরে চলে গেলে তিনি সইতে পারবেন না। এইজন্য তিনি পিতা এবং পুত্র দুজনের কাছেই পরস্পরের পরিচয় লুকিয়েছেন।
কিন্তু সোহরাবের মনে তখন উচ্চাকাঙ্খা বাসা বেঁধেছে। দুনিয়াদারির কিছুই জানত না সে। সে মনে মনে ভাবলো, একটা বিরাট সৈন্যদল বানিয়ে সে ইরানের সম্রাটকে হারিয়ে দেবে। তারপর তার বাবা আর মা হবেন ইরানের সম্রাট আর সাম্রাজ্ঞী। খুবই অল্পবয়সী এবং তখনও অপরিণতমনষ্ক ছিলো সে, তাই এরকম ভাবনাচিন্তা করেছিলো কিছু না বুঝেই।
তুরাণের সম্রাট আফ্রাসিয়াবের সাহায্যে সে এক বিরাট সেনাবাহিনী জোগাড় করে ইরানের সীমান্তের দিকে রওয়ানা হল।
সাপিদ দুর্গ সহজেই জয় করে নিলো তারা। দুর্গের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত হাজিরকে বন্দী বানালো তারা। দুর্গে গজদাম নামে এক সংবাদপ্রেরক ছিলো। সে ইরানের সম্রাট কাইকাসের কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য চিঠি লিখলো। এটাও লিখলো যে মাত্র চোদ্দ বছরের বালক সোহরাব তুরাণের বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছে। আর বলতে ভুললো না,যে সোহরাবের চেহারা অনেকটা রুস্তমের মত। সংবাদবাহকের সাথে গজদামও নিজের পরিবারসহ লুকিয়ে দুর্গের গোপন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলো।
সম্রাট কাইকাস চিঠি পাওয়া মাত্র এক গোপন সভা ডাকলেন। তাঁর বিশ্বস্ত মহাবীররা সেই সভায় যোগ দিলেন। তাঁরা সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে সোহরাবকে ঠেকাতে রুস্তমের থেকে ভালো আর কেউ হতেই পারেন না। সেই মত এক গিভ নামের এক মহাবীরকে জাবুলিস্তানে গিয়ে রুস্তমের সাথে কথা বলানোর জন্য দূত হিসাবে বেছে নিলেন। রাজা এক চিঠি লিখলেন রুস্তমের নামে। সেখানে প্রথমে রুস্তম আর তাঁর পরিবার রাজপরিবারকে কত সাহায্য করেছেন পুর্বে এইসব লিখলেন ইনিয়ে বিনিয়ে, তারপর লিখলেন সীমান্তে এক বিপদ এসে উপস্থিত হয়েছে, রুস্তম যেন সাহায্য করেন।
চিঠি নিয়ে গিভ পৌঁছলেন জাবুলিস্তানে। চিঠি পড়া মাত্রই সাহায্য করার ইচ্ছে রুস্তমের খুব একটা ছিলো না, কারণ তিনি সম্রাটের আজ্ঞাবহ দাস নন, একজন সাহায্যকারী মাত্র। কিন্তু গিভ তাঁকে ক্রমাগত অনুরোধ করতে থাকলে চতুর্থদিনে তিনি যুদ্ধযাত্রা করতে প্রস্তুত হন।
রাজপ্রাসাদে যতক্ষণে তাঁরা পৌঁছলেন সম্রাট কাইকাস তো ততক্ষণে রেগে আগুণ। কারণ এতো দেরী হয়েছে এঁদের আসার। তিনি নির্দেশ দিলেন রুস্তম আর গিভকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হোক। এমনকি একজন মহাবীর টুস তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য এগিয়েও এলেন, কিন্তু রুস্তম তাঁকে একটা বাচ্চার মত ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
রুস্তম কাইকাসকে বললেন, “ আমি আপনাকে আমার প্রভু বলে মনে করি না। আমার প্রভু হলেন ঈশ্বর। আমার ঘোড়া রক্ষ হল আমার সিংহাসন, আর আমার শিরস্ত্রাণ আমার মুকুট। এর বেশি আমার আর কিছু লাগবে না। আমি আপনার প্রাণ এবং সিংহাসন অগুনতিবার রক্ষা করেছি।” এটুকু বলে রুস্তম রেগে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করলেন, এবং যাওয়ার আগে অন্যান্য মহাবীরদের জানালেন, তাঁরা যেন নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেন, কারণ তিনি ইরান ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছেন।
মহাবীররা সম্রাটের এই আচরণে অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। তাঁরা বয়োজ্যেষ্ঠ গুদার্জের কাছে গিয়ে বললেন সম্রাটের সাথে কথা বলে কিছু একটা ব্যবস্থা করতে। গুদার্জ সম্রাটকে গিয়ে বললেন, সত্যিই তো রুস্তম বহুবার ইরানের সম্রাটের সিংহাসন এবং প্রাণরক্ষা করেছেন, রাজার এমন কথা বলা উচিত হয়নি।
গুদার্জ এও বললেন যে গজদাম তাঁর লেখা চিঠিতে পরিষ্কার জানিয়েছেন যে সোহরাবকে ঠেকানোর জন্য রুস্তমকেই দরকার। আর সম্রাট তাঁকেই চটিয়ে দিয়েছেন, এবার যদি ইরানের হার হয়, তাহলে তার জন্য সম্রাট নিজেই দায়ী থাকবেন।
অবশেষে রাজা কাইকাস নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলেন। তিনি গুদার্জকে পাঠালেন রুস্তমের কাছে, একটি চিঠিও দিলেন ক্ষমাপ্রার্থনা করে। গুদার্জের সাথে কিছু মহাবীররাও গেলেন, তাঁরা সবাই মিলে রুস্তমকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন রাজাকে ক্ষমা করে দেন। রুস্তম রাজার প্রতি রুষ্ট হলেও আসলে মনের দিক থেকে ভালো ছিলেন। তাঁকে বোঝাতে গিয়ে মহাবীররা বললে তিনি ইরান ছেড়ে চলে গিয়ে আসলে রাজাকে শাস্তি দিচ্ছেন না, শাস্তি পাচ্ছে সারা দেশবাসী। কারন তুরানের আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা দেশবাসীর নেই। রুস্তম তবুও আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন তিনি রাজার অধীনস্ত প্রজা নন, তাই রাজা তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারেন না।
রুস্তম যখন রাজী হলেন না ফেরত যেতে তখন গুদার্জ অন্য এক রাস্তা নিলেন তাঁকে রাজী করানোর। তিনি বললেন যদি রুস্তম চলে যান, তাহলে ইরানের রাজা, সৈন্য এবং প্রজারা ভাববেন যে তুর্কিস্তানের সদ্যযুবক বীরটির ভয়ে তিনি পালিয়ে যাচ্ছেন। সবাই ভাববে যদি মহাবীর রুস্তম এই বীরের সামনে দাঁড়াতে প্রস্তুত না হন, তাহলে এঁর সামনে আর কেউ টিকতে পারবে না, ফলে যুদ্ধ করতে কেউ রাজীই হবে না, সবাই যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। এই কথা রুস্তমের মনে গিয়ে লাগল, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি আবার ইরানে ফিরে আসবেন।
রাজা কাইকাস যখনই এই সংবাদ পেলেন যে রুস্তম ফিরে আসছেন, তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। রুস্তমকে স্বাগত করার জন্য বিরাট এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল। রুস্তম ফিরে আসার পর রাজা স্বয়ং তাঁর কাছে তাঁর পূর্ব ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলেন এবং সমাদরে রুস্তমকে স্বাগত জানালেন। তারপর রাজা এবং রুস্তম দুজনেই একে অপরকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করলেন, এবং রাজা রুস্তমের আসার আনন্দে এবং তাঁদের বন্ধুত্ব উদযাপন করতে এক জমকালো খানাপিনার আয়োজন করলেন।
পরের দিন সকালেই রাজা কাইকাস, রুস্তম আর অন্যান্য মহাবীররা ইরানের সৈন্যদল নিয়ে সাপিদ দুর্গের দিকে রওয়ানা হলেন। এই দুর্গেই সোহরাব তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে বাস করছিলেন।
যখন তুরানের এক সেনাপতি হোমান এবং সোহরাব ইরানের সৈন্যদল দেখলেন, তখন হোমান খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু সোহরাব নিজের লড়ার ক্ষমতা সম্পর্কে জানতেন তাই শুধুমাত্র উৎসাহিত হলেন। তাঁর মনে এক ক্ষীণ আশা ছিল যে তাঁর পিতা রুস্তমের সাথে তাঁর নিশ্চয়ই দেখা হবে সেইজন্যেও তিনি আনন্দিত হলেন।
ইরানের সেনাবাহিনী সাপিদ দুর্গের থেকে কিছুদুরে ঘাঁটি গাড়ল। রুস্তম ঠিক করলেন ছদ্মবেশ ধরে শত্রুশিবিরের কিছু সংবাদ জোগাড় করবেন, সেইমতো সন্ধ্যা নামতেই তিনি অন্ধকারে ছদ্মবেশে শত্রুপুরীতে গিয়ে একটা কোণায় লুকিয়ে থাকলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে বারমান আর হোমান এই দুই সেনাপতির সাথে সোহরাব শান্তভাবে যুদ্ধনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন। তাঁদের সাথে ছিলেন জিন্দেহ-রাজম, তিনি সমাঙ্গন রাজ্যের রাজপুত্র ছিলেন। তেহমিনা তাঁর এই ভাইটিকে সোহরাবের সাথে পাঠিয়েছিলেন এই আশায় যে তিনি রুস্তমকে চিনতে পারবেন ও সোহরাব এবং রুস্তমের সাক্ষাত করাবেন।
জিন্দেহ-রাজম দেখলেন এক কোণায় কিছু নড়াচড়া করছে, এখানেই রুস্তম লুকিয়ে ছিলেন। তিনি ভালো করে দেখার জন্য কোণায় গেলেন। অন্ধকারে রুস্তম জিন্দেহ-রাজমকে চিনতে পারলেন না, আর জিন্দেহ-রাজমও রুস্তমের কেবলমাত্র ছায়া দেখতে পেলেন, তিনি আরেকটু হলে চেঁচিয়ে সৈন্যদলকে ডাকতে শুরু করছিলেন প্রায় কিন্তু রুস্তম তাঁর তলোয়ারের এক প্রহারে তাঁর গলা কেটে ফেললেন। রুস্তম এবং সোহরাব দুজনকেই চেনেন এমন শেষ ব্যক্তিটিও মারা গেলেন।
রুস্তম নিজের শিবিরে ফিরে এসে তুরানীদের যুদ্ধপরিকল্পনার কথা বাকীদের জানালেন, রাজাকেও একটা সংবাদ পাঠানো হল। এমনকি রুস্তম সোহরাবের বর্ণনাও দিলেন অন্যান্য মহাবীরদের, আর এও জানালেন যে যেকোনও মুহুর্তে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
পরদিন সোহরাব তাঁর কালো ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের এক চূড়ায় উঠলেন যেখান থেকে পুরো ইরানের সৈন্যদল দেখা যায়। তিনি সাপিদ দুর্গের বন্দী দুর্গাধক্ষ্য হাজিরের কাছে জানতে চাইলেন, বিভিন্ন ধরনের শিবিরগুলি কোন কোন মহাবীরের। হাজির সবকটি শিবিরের মহাবীরের নাম বললেও রুস্তমের শিবিরটির ক্ষেত্রে মিথ্যে বললেন, বললেন যে ওটা চীন থেকে আসা একজন নতুন মহাবীরের শিবির। তিনি মিথ্যে বলেছিলেন কারণ তিনি ইরানের সর্বাপেক্ষা সেরা মহাবীরকে রক্ষা করতে চাইছিলেন, যেকোনো ধরনের আকস্মিক আক্রমণের থেকে। রুস্তমের সম্পর্কে কোনো খবর জোগাড় করতে না পেরে সোহরাব অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিলেন।
তারপর সোহরাব একাই ঘোড়া নিয়ে ইরানের শত্রুশিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি সিধে রাজা কাইকাসের শিবিরে গেলেন এবং বললেন যে তিনি রাজাকে সরাসরি আহ্বান করছেন যে রাজার যেকোনো মহাবীর তাঁর সাথে যুদ্ধ করুক। রাজা কাইকাস তো সোহরাবের বিরাট চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি টুসকে পাঠালেন রুস্তমকে ডাকার জন্য। এই জরুরী সংবাদ নিজের শিবিরে পাওয়া মাত্রই রুস্তম যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওয়ানা হলেন।
দুইজন মহাবীরই সামনাসামনি হলেন, এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে এক আলাদা স্থানে তাঁরা দ্বৈরথ শুরু করবেন। সেই জন্যে তাঁরা রওয়ানা দিলেন, পথে রুস্তমের প্রতি সোহরাব এক অকারণ টান অনুভব করলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনিই কি মহাবীর রুস্তম?” সোহরাবকে প্যাঁচে ফেলার জন্য রুস্তম উত্তর দিলেন “রুস্তমের মত মহাবীরের তুলনায় আমি নিতান্তই একজন সামান্য সৈন্য।”
এক আলাদা স্থানে গিয়ে দুই মহাবীরই যুদ্ধ শুরু করলেন প্রথমে বর্শা এবং তলোয়ার নিয়ে তারপরে মুগুর আর তীরধনুক নিয়ে। তাদের যুদ্ধ এত তীব্র ছিল যে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সব শেষ হয়ে গেল, দুইটি ঘোড়াই ক্লান্ত হয়ে গেলো কিন্তু কেউ কারোর থেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হলেন না। অবশেষে তাঁরা ঠিক করলেন পরের দিন আবার এইস্থানেই তাঁরা যুদ্ধ করবেন, কিন্তু এবার বিনা অস্ত্রে।
রুস্তম এমন প্রতিযোগিতার সামনে কখনো পড়েননি। তিনি ফিরে এসে রাজা কাইকাসকে খবর পাঠালেন, যদি যুদ্ধে তার মৃত্যু হয় তাহলেও যেন এই যুদ্ধ আর করা না হয়, কারণ ইরানে কোনো এমন যোদ্ধা অবশিষ্ট নেই যে সোহরাবের শক্তির সাথে পেরে উঠবে।
অন্যদিকে সোহরাবের মনে বাসা করেছে অনুতাপ। একদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী তার থেকে অনেকটাই বড়। তাছাড়া রুস্তমকে দেখে তিনি খুবই আকর্ষিত হয়ে পড়েছেন। তাঁর মনে সন্দেহও হচ্ছে ইনিই তাঁর পিতা রুস্তম নন তো?
পরের দিন আবার সোহরাব আর রুস্তমের যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা হল। সোহরাব আবার রুস্তমকে অনুরোধ করলেন নিজের সঠিক পরিচয় দেওয়ার, কারণ তিনি রুস্তমের প্রতি অত্যন্ত আকর্ষণ বোধ করছেন। কিন্তু রুস্তম মনে করলেন যে নবীন মহাবীরের এই আকর্ষণ তাঁকে ফাঁদে ফেলার এক চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়, তাই আবারো তিনি তাঁকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন।
এই যুদ্ধে কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহরাব রুস্তমকে পরাজিত করে তাঁর বুকের উপর বসলেন, যখন এক ছুরি দিয়ে তিনি রুস্তমকে হত্যা করতে যাবেন, তখন রুস্তম এক চালাকি করলেন। তিনি সোহরাবকে জানালেন যে প্রথমবার যে মাটিতে পড়েন সেই যোদ্ধাকে হত্যা করার নীতি ইরানে নেই। সোহরাব এই কথাকেই সত্য মেনে নিয়ে রুস্তমকে ছেড়ে দেন। তারপরে দুজনেই নিজের নিজের শিবিরে ফিরে আসেন। সোহরাব হোমানকে কি হয়েছিল জানান এবং তখন হোমান জানান যে তাঁকে বোকা বানানো হয়েছে।
এদিকে এই ঘটনার পর রুস্তমের অন্তরাত্মা পর্যন্ত ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। তিনি ইশ্বরের কাছে নিজের শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করলেন। তিনি নিজের শক্তি ফিরে পেলেন এবং পরের দিন আবার নতুন শক্তিতে সোহরাবকে হাতাহাতি করে যুদ্ধ করতে আহ্বান করলেন।
নতুন শক্তি পেয়ে রুস্তম সোহরাবের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলেন, এবং কিছু পরে জয়ী হয়ে সোহরাবের বুকে চেপে বসলেন। আর সময় নষ্ট না করে তিনি এক তীক্ষ্ণ ছোরা সোহরাবের বুকে গেঁথে দিলেন। সোহরাব আহত হওয়ার থেকেও বেশী আশ্চর্য হলেন। তিনি আশা করেছিলেন তিনি যেমন ছেড়ে দিয়েছিলেন, এই যোদ্ধাও প্রথমবার নিশ্চয়ই তাঁকে ছেড়ে দেবেন। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে রুস্তমের উপর চেঁচিয়ে উঠলেন। তিনি বললেন এবার তাঁকে মারা যেতে হবে তাঁর পিতার মুখ না দেখেই। এই যোদ্ধা যে প্রতারণা করে তাঁকে হত্যা করেছেন, সেই খবর ওঁর পিতা রুস্তম পেলে তিনি নিশ্চয়ই সারাপৃথিবী তোলপাড় করে যোদ্ধাকে খুঁজে বার করবেন এবং প্রতিশোধ নেবেন।
এই কথাগুলি শুনে রুস্তম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সোহরাবই যে রুস্তমের ছেলে এমন কোনো প্রমাণ তাঁর কাছে আছে কি না? সোহরাব তাঁর বর্ম ছিঁড়ে ফেলে বাহুর উপরের সেই রত্নটি দেখালেন। এই সেই রত্ন যা রুস্তম তাঁর স্ত্রী তহমিনাকে দিয়েছিলেন অনাগত সন্তানকে দেওয়ার জন্য। রত্নটি দেখার পর রুস্তম তাঁর ছেলের মস্তক কোলে নিয়ে দুঃখে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। তিনি যখন অনুভব করলেন তিনি নিজের হাতে তাঁর ছেলের মৃত্যু ডেকে এনেছেন তখন তাঁর অনুতাপের সীমা রইলো না।
সন্ধ্যা অবধি রুস্তমকে না ফিরতে দেখে অন্য মহাবীররা উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁকে খুজতে শুরু করলেন। এক যায়গায় এসে দেখেন রুস্তমের ঘোড়া একা দাঁড়িয়ে আছে। এঁর থেকেই তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌছলেন যে রুস্তম নিশ্চয়ই মারা গেছেন। তাঁরা কাইকাসের কাছে গেলেন ও এই সংবাদ জানালেন। রাজা কাইকাস তৎক্ষণাৎ তুরানী শিবিরে এই খবরের সত্যাসত্য জানার জন্য দূত পাঠালেন।
সোহরাব তখন নিজের শেষ শ্বাসগুলি গুনছেন। মৃত্যুর সময়েও তিনি খুশি, কারণ অবশেষে তাঁর পিতার সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়েছে। তিনি রুস্তমকে নিজের শেষ ইচ্ছে জানালেন, তাঁর মৃত্যুর পর তুর্কী এবং তুরানী সৈন্যদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয় কারণ তাঁর অভাবে এঁরা কেউই ইরানী সৈন্যদল আর মহাবীরদের মোকাবিলা করতে পারবে না।
রুস্তম তাঁর সন্তানের শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে ইরানের শিবিরের দিকে রওয়ানা দিলেন। রুস্তমকে দেখার পর ইরান শিবিরে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কিন্তু রুস্তমের সকল পোশাক ছেঁড়া এবং চোখ কান্নায় লাল দেখে সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। রুস্তম জানালেন কিভাবে তিনি তাঁর নিজের ছেলেকে নিজের হাতে ছুরি মেরেছেন। সম্পুর্ণ ইরানীয় শিবির এই ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। রুস্তম নিজের ভাই জাভেরাকে হোমানের কাছে পাঠালেন এই সংবাদ দেওয়ার জন্য। হোমান তুরানের সেনাপতি হলেও সোহরাবের যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষাগুরুও ছিলেন, তিনিও এই সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি জানালেন, সব দোষ আসলে হাজিরের। তিনিই ইচ্ছে করে রুস্তমের পরিচয় সোহরাবকে দেননি।
জাভেরা ইরানের শিবিরে ফিরে রুস্তমকে জানালেন এই ঘটনার পিছনের আসল খলনায়ক হলেন হাজির। রাগে উন্মাদ হয়ে রুস্তম ছুটে গেলেন সাপিদ দুর্গে হাজিরকে হত্যা করতে। তিনি যখন হাজিরকে মেরে ফেলার জন্য প্রস্তুত তখন অন্যান্য মহাবীররা তাঁকে নিরস্ত করেন এই বলে যে হাজির মনে করেছিল এতে রুস্তমের ভালোই হবে, তার আসল উদ্দেশ্য রুস্তমকে রক্ষা করাই ছিল। রুস্তম তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার নিজের আহত পুত্রের কাছে চলে গেলেন, সাথে টুস, গুদার্জ এবং গাস্তাহামও গেলেন।
হঠাৎ রুস্তমের মনে পড়ল রাজা কাইকাসের কাছে ‘নোশদারু’ নামের এক ওষুধ আছে যা সবথেকে খারাপ আঘাতকেও সারাতে পারে। তিনি গুদার্জকে অনুরোধ করলেন সেই ওষুধ যত শীঘ্র সম্ভব নিয়ে আসতে। গুদার্জ রাজা কাইকাসের কাছে গিয়ে অনুরোধ জানালে রাজা কাইকাস সেই ওষুধ দিতে অসম্মতি জানান। তাঁর ভয় ছিল এই অসীম বীর বাবা আর ছেলের জুটি এমন এক সেনাবাহিনী বানাবেন যাদের পরাস্ত করা অসম্ভব, এবং তাঁকে সহজেই হারিয়ে রাজত্ব দখল করে নেবে। খালি হাতে গুদার্জ রুস্তমের কাছে ফিরে এলেন, এবং বললেন রাজা ওষুধ দিতে অস্বীকার করেছেন, রুস্তমের নিজে গিয়ে চাওয়া উচিত। রুস্তম রেগে উঠে তখনই রাজার কাছে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু তখনই সোহরাব শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
সোহরাবের মৃত্যুতে রুস্তম একেবারে ভেঙ্গে পড়েন। তিনি শোকাভিভূত হয়ে অন্যান্য মহাবীরদের অনুরোধ করেন যে রাজা কাইকাস যেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঘোষণা করেন।
সোহরাবের প্রাণহীন দেহ জাবুলিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাঁর দেহ দেখে তাঁর পিতামহ জাল এবং পিতামহী রোদাবেহ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। রুস্তম তাঁর স্মৃতিতে এক দাখমা ( যেখানে জরাথ্রুষ্টিয়রা মৃতদেহ উন্মুক্ত করে রাখেন) তৈরি করান। এই নতুন দাখমাটির আকার ঘোড়ার খুরের মত, এখানেই সোহরাবের দেহ রাখা হয়।
সোহরাবের মৃত্যুর খবর হোমান সমাঙ্গনের রাজার কাছে পৌঁছে দেন। তিনি এই সংবাদ তহমিনাকে দেন। তহমিনা খুব আগ্রহভরে তাঁর সন্তান এবং স্বামীর প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছিলেন। এই সংবাদে তিনি একেবারে ভেঙ্গে পড়েন। তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না যে তাঁর সন্তান এখন কেবলমাত্র এক প্রাণহীন শরীর।
দুঃখে পাগলিনী হয়ে তিনি এমন সকল জিনিস ধ্বংস করে ফেলেন যার সাথে সোহরাবের বিন্দুমাত্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পুত্র হারানোর যন্ত্রণা তাঁর কাছে এতই প্রবল ছিল, যে তিনি বারবার জ্ঞান হারাতে থাকেন। এক কালো পোষাক পরে অসাড় হয়ে বসে থাকেন কেবল। কিছুদিন পরে তাঁরও মৃত্যু হয়।
No comments